
মনোজিত মৌলিক
স্বাধীনতা লাভের পর ভারতে খেলাধুলোর প্রথম বড়ো মাপের ইভেন্ট হয় ১৯৫১ সালে। সে বছরের এশিয়ান গেমস আয়োজনের পর ভারত ফের এশিয়ান গেমস আয়োজন করে ১৯৮২ সালে। এই এশিয়ান গেমস আয়োজনের আগে কেন্দ্রীয় ক্রীড়া মন্ত্রক তৈরি হয়। ১৯৮৫ সালে আন্তর্জাতিক যুব বর্ষ উদ্যাপনের সময় এই মন্ত্রকের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় কেন্দ্রীয় যুবকল্যাণ ও ক্রীড়া মন্ত্রক। আমাদের দেশে যে খেলাগুলির চল রয়েছে সেগুলি হলো ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, টেনিস, ব্যাডমিন্টন, টেবল টেনিস, বাস্কেটবল, গল্ফ, বক্সিং, কুস্তি, ওয়েটলিফটিং ও পাওয়ারলিফটিং, তিরন্দাজি, ভলিবল, হ্যান্ডবল, তাইকোন্ডো, রাগবি, সাইক্লিং, মাউন্টেন বাইকিং, রোড সাইক্লিং, ইকুয়েস্ট্রিয়ান, অ্যাথলেটিক্স ও ট্রায়াথলন, নৌকা বাইচ, জিমন্যাসটিক্স। বিলিয়ার্ডস ও স্নুকার, দাবা, কবাডি, মোটরস্পোর্টস, কর্ফবল, কারাটে, ফ্লোরবল, নেটবল, থ্রোবল, ল্যাকরোস, আমেরিকান ফুটবল, পোলো, বাস্কেটবল ও সফ্টবল, রব ক্লাইম্বিং, সেপাক টাকরোর মতো নন-অলিম্পিক স্পোর্টসও হয়। এ ছাড়াও রয়েছে কিছু ঐতিহ্যশালী আঞ্চলিক খেলা। এগুলি হলো বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে মুরগি লড়াই, জালিকাট্টু, ডান্ডাগুলি, কাঞ্চা, ঘুড়ি ওড়ানোর লড়াই, বিভিন্ন রকমের মার্শাল আর্ট, খো-খো। ফুটসল, সাইকেল পোলো, ব্রিজ, ক্যারম, রোয়িং, স্কোয়াশ, সাঁতার, টাগ অব ওয়ার, যোগা, প্রতিযোগিতামূলক সেইলিং ইত্যাদি খেলারও চল রয়েছে এ দেশে। রয়েছে বিভিন্ন সরকারি পুরস্কার। রাজীব গান্ধী খেলরত্ন পুরস্কার এ দেশে ক্রীড়াক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মান।

ভারতে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট আয়োজিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে। এশিয়ান গেমসের পাশাপাশি ১৯৮৭, ১৯৯৬ ও ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপ ভারতে অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য আইসিসি ইভেন্টের মধ্যে ২০১৬ সালে হয় ওয়ার্ল্ড টি ২০ ও মহিলাদের টি ২০ বিশ্বকাপ। ২০০৭, ২০১১ ও ২০১৪ সালে হয় পুরুষদের হকির চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। পুরুষ ও মহিলাদের হকি ওয়ার্ল্ড লিগও অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৩ সালে অ্যাফ্রো এশিয়ান গেমস, ২০০৮-এ এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ, ২০১০ সালে হকি বিশ্বকাপ ও কমনওয়েলথ গেমস হয়। চেন্নাই ওপেন, মুম্বাই ম্যারাথন, দিল্লি হাফ ম্যারাথন, ইন্ডিয়ান মাস্টার্স গল্ফ, ইন্ডিয়া ওপেন, রয়্যাল ইন্ডিয়ান ওপেন ব্যাডমিন্টন-সহ বেশ কিছু প্রতিযোগিতাও আয়োজিত হয় প্রতি বছর। ১৯২৪ সাল থেকে হয়ে আসছে জাতীয় গেমস। ১৯৮৯, ২০১৩ ও ২০১৭-র এশিয়ান অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ, ফর্মুলা ওয়ানের ইন্ডিয়ান ওপেন গ্রাঁ প্রি, সাউথ এশিয়ান গেমস, এশিয়ান রেসলিং, এশিয়ান সাইক্লিং, পুরুষদের ব্যক্তিগত বিভাগের এশিয়ান স্কোয়াশ চ্যাম্পিয়নশিপ, শ্যুটিংয়ে আইএসএসএফ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে টেবল টেনিসে ইন্ডিয়া ওপেন, ইন্ডিয়া ওপেন গল্ফ, বাস্কেটবলে অনূর্ধ্ব ১৬ মহিলা এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, মহিলা যুব বক্সিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় ভারত। ক্রিকেটে আইসিএল ক্লিক না করলেও আইপিএল তুমুল জনপ্রিয় হয়। আইপিএলের অনুকরণে বিভিন্ন দেশে ক্রিকেট লিগ চালু হয়, আমাদের দেশেও বিভিন্ন ক্রীড়াক্ষেত্রে আইপিএলের ধাঁচে লিগ চালু হয়।

ফিফার অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপও আয়োজিত হচ্ছে ভারতে, ফাইনাল-সহ বেশ কয়েকটি ম্যাচ হবে কলকাতায়। আগামী বছর হবে হকি বিশ্বকাপও। দেশে সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে ভারতের ফাইনালে ওঠা এবং অল্পের জন্য কাপ হাতছাড়া হওয়ার পর আজকাল মহিলা ক্রিকেট নিয়েও আগ্রহ বাড়ছে ক্রীড়াপ্রেমীদের। মহিলা বিশ্বকাপে ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ টিভি ভিউয়ারশিপে সর্বকালীন রেকর্ড গড়েছে, এই ম্যাচে চোখ রেখেছিলেন ১২৬ মিলিয়ন মানুষ যা এবারের আইপিএল ফাইনালের সমান। শুধু তাই নয়, ভিউয়ারশিপের গড় বলছে, প্রতি মুহূর্তে ১৯.৬ মিলিয়ন দর্শক এই ম্যাচে চোখ রেখেছিলেন। ভারতে মহিলাদের খেলার ক্ষেত্রে ১.৯ মিলিয়ন ডিজিটাল ভিউয়ারশিপও এক অনন্য রেকর্ড। টেস্ট, ওয়ান ডে-র পর টি ২০— সব ফরম্যাটেই ভারতীয় দলের ক্রিকেট মাঠে দাপট দেখানো এবং আইপিএলের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট। ক্রিকেট আজ আর উচ্চবিত্তের খেলা নয়। মধ্যবিত্ত এমনকী নিম্নবিত্ত পরিবার থেকেও উঠে আসছেন ক্রিকেটাররা। প্রচুর আকাদেমিও তৈরি হয়েছে।
ক্রিকেটের পরেই ফুটবলের কথা আসে। জনপ্রিয়তার বিচারে জাতীয় লিগ থেকে তৈরি হওয়া আই লিগকে টেক্কা দিয়েছে আইএসএল। ফিফা ক্রমতালিকায় ভারত ঢুকে পড়েছে প্রথম একশো দেশের মধ্যে। প্রো কবাডির সৌজন্যে কৌলীন্য হারানো কবাডি ঘিরেও উন্মাদনা বাড়তে শুরু করেছে। এখনও পর্যন্ত ফিল্ড হকিতে আটটি অলিম্পিক্স সোনা পেয়েছে ভারত— ১৯২৮, ১৯৩২, ১৯৩৬ সালের পাশাপাশি স্বাধীনতার পর ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৬, ১৯৬৪ ও ১৯৮০ সালের অলিম্পিক হকিতে। ১৯৬০ সালে রুপো ও ১৯৬৮ ও ১৯৭২ সালে ব্রোঞ্জ জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে ভারত হকি বিশ্বকাপও জেতে। সাতের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতীয় হকির আধিপত্য থাকলেও গ্রাফ নিম্নমুখী হতে শুরু করে এর পর থেকেই। এমনকী ২০০৮ অলিম্পিক্সে যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়া বা ২০১২-তে সবচেয়ে নীচে থেকে অলিম্পিক অভিযান শেষ করার করুণ কাহিনিরও সাক্ষী থাকতে হয়েছে দেশবাসীকে। আশির দশক থেকে ভারতীয় হকির গৌরব ম্লান হতে থাকার পিছনে বড়ো কারণ অ্যাস্ট্রোটার্ফের অভাব। স্রেফ এ কারণেই ভারতকে টেক্কা দিয়ে যায় পিছিয়ে থাকা অন্য দেশগুলিও। ২০০০ সালের পর থেকে বিভিন্ন বড়ো শহরে অ্যাস্ট্রোটার্ফ বসতে থাকে। আক্ষেপ ধরা পড়ে ফুটবলেও। একসময় যেসব দেশকে কড়া টক্কর দিতো বা হারাতো ভারত তারা বিশ্বকাপ খেলার স্বাদ পেলেও ভারতের কাছে বিশ্বকাপ খেলা থেকে গেছে স্বপ্ন হয়েই। চলতি বছর যুব বিশ্বকাপে আয়োজক দেশ হিসেবে ভারত খেলবে, অনেকে আশায় বুক বাঁধছেন হয়তো এর থেকেই অন্য খাতে বইবে ভারতীয় ফুটবল।

১৯৮০ সালে অলিম্পিক পদক জয়ের পর ফের পদক জিততে অপেক্ষা করতে হয় ১৬ বছর। ১৯৯৬ সালে টেনিসে ব্রোঞ্জ জেতেন কলকাতার ছেলে লিয়েন্ডার পেজ। আর পরবর্তী সোনার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২৮ বছর, অভিনব বিন্দ্রা ২০০৮-এ শ্যুটিংয়ে সোনা জয়ের পর আর অবশ্য অলিম্পিকের আসর থেকে সোনা আসেনি দেশে। ব্যক্তিগত দক্ষতায় ভারোত্তলন, শ্যুটিং, বক্সিং, কুস্তি, ব্যাডমিন্টনে অলিম্পিক পদক এসেছে। ২০১৬ সালের অলিম্পিক্সে এ দেশ থেকে সর্বাধিক প্রতিযোগী পাঠানো হলেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের অনেক দূরেই থামতে হয়েছে। ২০১৬ সালের অলিম্পিক্সে দেশের ব্যর্থতার কারণে ২০১৮ সালের কমনওয়েলথ গেমসে সাফল্যের রোডম্যাপ তৈরির লক্ষ্যে এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে ক্রীড়াক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে ১,৯৪৩ কোটি টাকা, যা গতবারের তুলনায় ৩৫০ কোটি বেশি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সামগ্রিকভাবে ক্রীড়াক্ষেত্রকে দিশা দেখাতে ব্যর্থ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রকে থাকার সময় তবু কিছুটা দিশা দেখিয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করেছিলেন। এমনকী বাংলার বাজেট কেন্দ্রীয় বাজেটের পাশে রাখলেই দেখা যাবে খেলাধুলোর প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতার ছবিটা। সাইয়ের ভূমিকাও বারবারই আসে আতসকাচের তলায়। বাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের সময় ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল নামমাত্র। মা-মাটি-মানুষ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিন বছরের মধ্যেই ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের জন্য বাজেট বরাদ্দ ৭ গুণ বৃদ্ধি পায়। ২০১৭-১৮ মরশুমে বরাদ্দ করা হয়েছে ৪৭৬.৬৫ কোটি টাকা। ক্রীড়াবিদদের সম্মানিত করার পাশাপাশি রাজ্য সরকার জোর দিয়েছে পরিকাঠামো তৈরির ওপর। রীতিমতো ক্রীড়ানীতি তৈরি করে সমস্ত খেলাধুলোকেই সমান গুরুত্ব দিচ্ছে রাজ্য সরকার। বিভিন্ন ক্রীড়াক্ষেত্রের জন্য আকাদেমিও তৈরি করেছে এবং করছে। ছোটো-বড়ো ক্লাবগুলির পাশাপাশি বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের আওতাভুক্ত বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থাকে পরিকাঠামো উন্নয়নে আর্থিক সহযোগিতার নিদর্শন দেশে দৃষ্টান্তস্বরূপ। ফাইনাল-সহ যুব বিশ্বকাপ আয়োজনেও দেশের বাকি রাজ্যগুলিতে টেক্কা দিতে তৈরি বাংলা।
তবে অনেকে হয়তো খেয়াল করেননি, অন্য দেশে থাকলেও আমাদের দেশে জাতীয় খেলা বলে কিছু নেই। ২০১২ সালে এক আরটিআইয়ের জবাবে এ কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। অলিম্পিকের হকিতে আটটি সোনা জয়ের সুবাদে এই খেলাকেই জাতীয় খেলা বলে চিহ্নিত করা হতো। ভারতে বহু খেলার পাশে মাইনর স্পোর্টসের তকমাও রয়ে গেছে। এর অনেকাংশেই দায়ী খেলাধুলোয় রাজনীতির হস্তক্ষেপ বা কর্তাদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ন্যাশনাল স্পোর্টস ফেডারেশনের আওতায় না থাকা বিসিসিআই শুধু দেশেই নয়, বিশ্ব ক্রিকেটে যেভাবে ধনী বোর্ড হিসেবে সমীহ আদায় করেছে বা যেভাবে ক্রিকেটের বিকাশে কাজ করে চলেছে তা অন্য ক্রীড়াসংস্থাগুলি অনুসরণ করলে ভালো হতো বলে মনে করেন অনেক ক্রীড়া বিশেষজ্ঞই। তবু লোধা কমিশনের রিপোর্ট বিসিসিআই-সহ অন্য ক্রীড়াসংস্থার কর্মপদ্ধতিকে কীভাবে বদলে দেয় তার আঁচ মিলবে আগামী দিনে।
সংগ্রমী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ১১ আগস্ট ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত
Leave a Reply