
জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৮ নং কিস্তি
কেউ কোনও কথা বলছে না। চারদিক নিস্তব্ধ।
মাসি কোমরের কাপরটা ঢিলে করে একটা কাপরের পোঁটলা বার করলো। দেখেই মনে হচ্ছে বহু বছরের পুরনো।
সবাই বিষ্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে।
অনি।
বলো।
এউটা ছোট গিন্নীর হাতকে দে।
কি আছে এতে?
দে-না।
আমি পোঁটলাটা হাতে নিয়ে মাসীমনির হাতে দিলাম।
মাসীমনি মৌসুমীমাসিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে।
দিছু।
দিয়েছি।
ছোটগিন্নী।
বলো।
এউটা খুলি দেখতো চিনতি পারু কিনা।
মাসীমনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমি পোঁটলাটা নিজে হাতে খুললাম।
দেখলাম রূপোয় বাঁধানো দুটো পাথরের আংটি। একটা পোখরাজ একটা গোমেদ। আর একটা রুপোর তাবিচ। মাসীমনির হাতে দিলাম।
মাসীমনি বিষ্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে। মৌসুমী মাসিও তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি ঝাপসা।
ও অনি।
বলো।
দিছু।
হ্যাঁ।
ছোটগিন্নী।
বলো।
চিনতি পারো কোনটা কার।
মাসীমনির চোখদুটো ছল ছল করে উঠলো।
তুমি এগুলো পেলে কোথায়?
আগে তুমি বলো কোনটা কার।
পোখরাজটা অধীপের আঙুলে ছিল, আর গোমেদটা অনিন্দিতার আঙুলে।
তাবিচটা?
অনিন্দিতার বাম হাতে ছিল।
মৌসুমী মাসির ঠোঁটদুটো কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠলো। মুখটা কেমন ভেঙেচুরে দুমড়ে গেল। ঠিক কাঁদছে না। তবু যেন কান্নাভেঁজা মুখ।
তুমি সত্যিকারের ছোটগিন্নীর দিদি। গলাটা কেমন যেন ভেঙে গেল।
মৌসুমীমাসির ফ্যাকাশে চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে। চারদিক নিস্তব্ধ। কেউ কোনও কথা বলছে না।
মাসীমনি নিচু হয়ে মৌসুমি মাসির হাতটা ধরলো।
তুমি তো অনি হওয়ার সময় ঝুমুর কাছে ছিলে।
হ।
এখানে তুমি ছাড়া ঝুমুকে আর কেউ দেখেনি।
মীর দেখছে। তখন অন্যে ছোটকত্তার কাছে পরতি আসতো।
মাসীমনি একবার মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাল। মীরচাচা বারান্দার নীচে মাঠে দাঁড়িয়েছিল উঠে এসে মাসীমনিকে প্রণাম করলো।
মীর। মৌসুমী মাসি ডাকল।
আমি এসেছি।
ছোটগিন্নীকে পেন্নাম করছু।
করছি।
তাকে তো পাবি নি। অখন এঁকে ঘর লিয়ে চ। যান্যে ছোটগিন্নীকে দেখছে তান্যে মরি ইছে, অখন তুই আমি বাঁইচে আছি।
চন্দ্রের ঘরের কাকা, কাকী আছে।
ছুঁচ্চাটার নাম মুখে লিবি নি। আধাভুদ্রা। মৌসুমীমাসি রেগে উঠলো।
মীরচাচা চুপ করে রইলো।
ও কামল্যার পো।
বলো।
পাঁচু, পচা এগিয়ে এলো।
অনির মাকে দেখিস লাই। সাক্ষাৎ দুগ্গা। নে ছোটগিন্নীকে পেন্নাম কর।
করছি।
তাঁতীর পো করছে।
ভানু এগিয়ে এলো।
করছি।
কেউ কিন্তু এই মুহূর্তে মাসির কথায় রাগ করছে না। কিংবা হাসছে না। পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে। তনু মিত্রার চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা।
চিকনা কাই গেলু।
আমি এখানে।
ছোটগিন্নী।
বলো।
চিকনা গেল জম্মে অনির ভাই ছ্যাল। এ জম্মে বেজাতের ঘরে জম্মেছে। তুমার দরে থায়।
মাসীমনি মৌসুমি মাসির মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
অনির মাকে গড় করছু।
মৌসুমিমাসির ফ্যাকেশে চোখ চিকনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
করেছি।
বড়োগিন্নী কাই?
এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
বড়োগিন্নী।
বলো।
তুমার যখন বে হয়, অনি তখন চার বছ্ছরের। ছোটগিন্নী মরি যেতে কত্তামা বড়কত্তার বে দিল। তুমার মনে আছে।
হুঁ।
তুমি ছোটগিন্নীকে দেখ লাই। অখন দেখি লাও।
কাকীমা চুপ করে আছে।
ছোটগিন্নী।
বলো।
আমি তুমার ঘরকে একবার গেছলি। তুমান্যে ত্যাখন সেঠিনু চইল্যা গেছলে।
আমি অবাক হয়ে মৌসুমী মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে। এতদিন ঘুণাক্ষরেও মাসির মুখ থেকে এ সমস্ত কথা জানতে পারিনি। বহু চেষ্টা করেছি। একটা কথাও বার করতে পারিনি।
মাসীমনি মৌসুমি মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে।
বড়কত্তা বড়ো কষ্টে মরছে। বুকে করে শ্বাস আকটেছিল। তুমাদের ঘরের জিনিষকে ফিরত করতে চেয়েছিল, তুমান্যে নিলে নি।
মৌসুমি মাসি থেকে থেকে কথা বলছে। কিন্তু প্রত্যেকটা কথার মধ্যে খোদাই করে রাখছে একটা দীর্ঘ ইতিহাসের স্বাক্ষর।
ও তাঁতীর পো।
ভানু এগিয়ে এলো।
বলো।
মোর হাত ব্যাগটা লিয়ে আয়।
পাঁচুর হাতেই ছিল এগিয়ে দিল।
ওটা কে?
পাঁচু।
ছোটগিন্নী ?
বলো।
পাঁচুর বাপ বড়ো কামল্যা বাসন্তীমার খেতটা ল্যাঙল দিত।
মাসী তাকিয়ে আছে মৌসুমী মাসির দিকে।
মৌসুমি মাসি কাঁপা কাঁপা হাতে থলের ভেতর কিছু খুঁজছে।
ও চিকনা।
ভানুকে বলো। আমি বুইসতে পারব নি।
মাসি ভানুর দিকে তাকিয়েছে।
হা থলির ভিতরকে ঠঙা আছে বার করে ছোটগিন্নীর হাতে দে।
ভানু হাত ঢুকিয়ে একটা খাম বার করে মাসির দিকে তাকাল।
এউটা।
মৌসুমি মাসি কাঁপা কাঁপা হাতে একবার খামটায় হাত বোলাল।
হ ছোটগিন্নীর হাতকে দে।
ভানু মাসিমনির হাতে দিল।
খামের ওপর নামটা দেখে মাসিমনির চোখ ছল ছল করে উঠলো।
বড়কত্তা দিছিল। তুমান্যে ছ্যালনি বলে দিছিনি। বড়কত্তাকে ফিরি আসি মিছে কথা কইছিলি। তুমান্য অনিকে লিবনি কইছ।
মাসীমনি মৌসুমি মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমার কথা বড়কত্তার মনকে লেয়নি। তাই লিজে গেছল। ত্যাখন কত্তামা বাঁইচে আছে।
ফিরে এসে কইলো, কত্তামার বয়স হইছে। অনিকে তুই দেইখ।
সেউ নু অনি মোর কাছে। আমি ছোটজাত তান্ন্যে বড়োজাত। খাওয়াইতে, পরাইতে পারতিনি। কত্তামা খাবে দিত। লইখ্য রাখতি হইতো, কইচা বড়ো চঞ্চল।
তুমি বললে না। মাসীমনি বললো।
কি?
এগুলো পেলে কোথায়?
কোন গুলান।
এই আংটি।
তানকাকে পুরা হবার সময় বড়কত্তা গা নু খুলে ফিকে দিছিল। মুই গুইড়্যা রাখছিলি।
অনিকে দাও নি কেন?
তুমাকে অনেক কথা কইবো। অনি মোর ছেইলে। তাকে সব কথা কওয়া যায়।
মৌসুমি মাসি কাপরের খুঁট দিয়ে চোখ মুছলো।
ও অনি।
বলো।
মোকে ধর।
আমি এগিয়ে এসে মাসির হাতটা ধরলাম। মাসি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
জানো ছোটগিন্নী, আমি সে বাড়িতে যখন প্রেথ্থম আইলি ত্যাখন তুমার বোন আইসে নি। মোর বয়স ষোল। সেউ বৎসর মোর বে হয়। মরদের সইঙ্গে ধান কাটতি আইসছিলি। অখন মোর বয়স চার কুড়ি এক। এ্যাতদিন যখের ধন আগলাইছি। পীরসাহেব মোর কথাটা শুনছে। নাইলে তুমি আইসব কেন।
মৌসুমী মাসি শক্ত করে লাঠিটা ধরেছে।
অনি।
বলো।
মোকে তুর ঘরের দাওয়ায় লিয়ে চ।
খাবে না।
খাতি ভাল লাগছে নি। তানকার জন্য কষ্ট হতিছে।
মৌসুমীমাসি আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো। লাঠি ঠুকে ঠুকে এগিয়ে চললো।
একটা বিশ্রী স্বপ্নে ঘুমটা ভেঙে গেল। কাকে যেন শ্মশানে নিয়ে চলেছি। মুখের আদলটা অনেকটা মাসিমনির মুখের মতো।
ঘুমটা ভেঙে যেতে একবার ঘরের চারদিক তাকিয়ে দেখলাম। সবে মাত্র ভোড়ের আলো ফুটেছে। আমি খাটে একলা শুয়ে আছি।
সকালের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। আবার ঘুমবার চেষ্টা করলাম।
নাঃ কিছুতেই ঘুম আসে না। হঠাৎ যেন ঘুমটা চোখ থেকে উধাও হয়ে গেল। মনে মনে বললাম নিজের দেখলে পরের হয়। পরের দেখলে নিজের হয়। মাসি কি পর? না আপন।
চোখ বন্ধ করে যে স্বপ্নটা দেখছিলাম ভাববার চেষ্টা করলাম। কিছুতেই মনে করতে পারছি না। শুধু চিতার লেলিহান আগুনের শিখা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
বুকের মঝখানে একটা টন টনে ব্যাথা কেমন দড়কচা মেরে আছে।
মুখ দিয়ে সমানে নোনা জলের স্রোত বেরিয়ে এসে বালিশ ভাসাচ্ছে।
কিছুক্ষণ ডানহাতটা বুকের মাঝখান রেখে উপুর হয়ে শুয়ে থাকলাম।
কালকের কথা বার বার মনে পরে যাচ্ছে।
মৌসুমি মাসি।
একটা সাঁওতাল মেয়ে। ছোটকত্তার শিশু সন্তানের জন্য নিজেকে কতটা স্যাক্রিফাইস করেছে। তখন কি মনাকাকার বিয়ে হয়েছিল? মনে হয়, হয়নি। ঠিক মন করতে পারছি না। মৌসুমি মাসির বর কালীচরণ। কাকা কাইল্যা বলে ডাকতো। এটুকু মনে আছে।
ভোররাতে অন্ধকার থাকতে ধান কাটতে গিয়ে সাপে কামরাল। এখনকার মতো আধুনিক চিকৎসা থাকলে হয়তো বেঁচে যেত। কালী মেসো বাঁচল না। গুণীনকাকাকে তখন দেখেছি কিনা মনে পরছে না। যতটা স্মরণ করতে পারছি। কালি খুড়োকে মাটিতে পোঁতা হয়নি। পোরান হয়েছিল। সেইদিন আমি বাঁধের ওপর মাসির কোলে বসে ছিলাম। মাসি আমাকে জাপ্টেধরে কাঁদছিল।
এইটুকু মনে করতে পারছি, বাকি সব ব্ল্যাক আউট।
ছেঁড়া ছেঁড়া কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ মাসি সেই সময় আমাকে তেল মাখিয়ে স্নান করাত। ঠাকুমার মুখটা মনে করতে পারছি না। শরীরটা বেশ বাল্কি। বয়স হয়েছিল। তারওপর বেশি নড়াচড়া করতে পারত না।
কাকা স্কুলে যাওয়ার আগে স্নান করে পূজো করতো। ঠাকুর ঘরে ঘণ্টার আওয়াজ হলেই আমাকে ঠাকুমা ডেকে পাঠাত। যা প্রসাদের থালা নিয়ে আয়। ঠাকুর ঘর থেকে দালান পেরিয়ে রান্না ঘরে আসতে আসতে শসাটা কলাটা পেটে চলে যেত।
সেই নিয়ে কাকার সঙ্গে ঠাকুমার প্রায় লাগত। ঠাকুমা দু-একটা যে খারাপ কথা বলতো না তা নয়। সেই সময় মৌসুমীমাসি আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে বাঁশবাগানে চলে যেত। শাসন করতো।
একটু বড় হতে কাকার হাত ধরেই হাটে গেছি। পাড়া চড়তে শিখেছি।
এখন বুকের ব্যাথাটা অনেকটা কম অনুভব করছি। মুখ দিয়ে আর নোনা জল কাটছে না।
চিত হয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম। তারপর উঠে বসলাম।
জানলা দিয়ে চোখ চলে গেল বাগানে। দাদা, ডাক্তারদাদা, আন্টি বাগানে পায়চারি করছে।
তনু, মিত্রা গেল কোথায়? বিছানার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ওরা কাল আমার কাছে শুয়েছিল।
সত্যি আমার কুম্ভকর্ণের ঘুম। বাড়িতে আগুন লেগেগেলেও বুঝতে পারব না।
বিছানা থেকে নেমে এসে দরজার দিকে তাকালাম। হাল্কা ভাবে ভেজিয়ে রাখা হয়েছে।
খাট থেকে নেমে টেবিলের কাছে আসতেই নিজের মনে নিজে হেসে উঠলাম।
টেবিলটা বেশ সুন্দর করে গোছান হয়েছে। ব্রাসে টুথপেস্ট লাগিয়ে বাথরুম গেলাম। নিজের কাজ সেরে বাইরে এলাম। বিছানার অবস্থা দেখে বুঝলাম, তখনও আমার ঘরে কেউ ঢোকে নি।
আলমাড়ি খুলতেই চোখের সামনে একটা গ্রীন কালারের পাঞ্জাবী চোখে পরলো। টেনে বার করে নিলাম। দেখলাম পাঞ্জাবীর মধ্যেই চোস্তাটা ভাঁজ করা আছে। গেঞ্জি-ড্রয়ার নিজেই বার করলাম।
অনেকদিন পর নিজে হাতে এই সব করলাম। কতদিন পর ঠিক মনে করতে পারছি না।
নিজেই নিজেকে পাটে পাটে ধোপ দুরস্ত করে তুললাম। নেহাত খারাপ লাগছে না।
চুলটা আঁচড়ে ঘরের দরজাটা খুলে বাইরে বেরতে গিয়ে সুরোর সঙ্গে ধাক্কা।
বত্রিশপাটি দাঁত বার করে হেসে উঠলাম। বিনিময়ে সুরো তেণ্ডাই-মেণ্ডাই করে উঠলো।
এই সাত সকালে ফুলবাবুটি হয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? কে ডাকলো তোমায়? ছোটোমা। সুরো তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো।
তোমার কোথাও যাওয়া হবে না, ওরা এয়ারপোর্ট থেকে রওনা হয়েছে।
তুই একাই সব বলে গেলি, আমাকে একটু আধটু চান্স দে।
কিসের চান্স। সুরো চিমটি কাটার ভঙ্গি করে তেরে এলো। আমি ওর হাতদুটো চেপে ধরলাম।
সক্কাল সক্কাল ফিট বাবুটি হয়ে কেটে পরার ধান্দা। মর এবার তোরা।
আমি হাসছি। সুরোর লাল চোখমুখও হাসছে।
অন্যদিন বাবুকে ডেকে তোলা যায় না। আজ নিজে নিজে উঠে….।
দেখলাম ও ঘর থেকে বৌদি, ছোটোমা গুটি গুটি পায়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
আমি সুরোর দিকে তাকিয়ে হাসছি।
তুই মিথ্যে সক্কাল সক্কাল চেঁচামিচি করলি।
কিরে সাতসকালে কোথায় যাবি! ছোটোমার চোখে বিষ্ময়।
কোথাও যাব না।
তাহলে!
তোমরা সকালে উঠে বাশি জামাকাপর ছেড়ে রাখতে বলো। তাই সেটা ছেড়ে, এটা পরলাম।
তুই কবে থেকে এতো ভদ্র হলি! বৌদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
কেন আমি অভদ্র ছিলাম।
ঠিক। অভদ্র ছিলি না। ভদ্রও যে ছিলি সেটা বলি কি করে।
তদন্ত কমিশন বসাও।
সুরো হাসছে। ধরি জল না ছুঁই পানি।
সত্যি কথাটা বলে ফেলতো কোথায় যাচ্ছিস। ছোটোমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
একটু চা খাওয়াবে। ভেবেছিলাম ও ঘরে ঢুকে চা চেয়ে সারপ্রাইজ দেব, সে গুড়ে বালি।
সুরো তখনও আমার দিক সন্দহের চোখে তাকিয়ে আছে।
তোর বড় উঠেছে। ডেকে তোল একটু গল্প করি।
তাই বলি কিসের এত হই চই। তুমি ঠিক শুনেছিলে সোনা, সুরোর গলা।
পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ডাক্তারদাদা, আন্টি, দাদা আমার দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে।
তুই এই সাত সকালে ফুলবাবু সেজে কোথায় যাচ্ছিস! ডাক্তারদাদা বললো।
সুরো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এলো।
আমার চোখটা খারাপ তাই না। সাবাই চোখে আতশ কাঁচ লাগিয়ে রয়েছে।
সুরো ওরকম করিস না মা। বেচারা জীবনে প্রথম না ডাকতে একা একা উঠেছে।
আন্টি বলে উঠলো।
সুরোর চোখ বড়ো বড়ো।
ও মা! তুমিও দেখি বড়োমার মতো কথা বলতে শুরু করেছো।
ছোটোমা, বৌদি হাসছে।
ঝামেলাটা কি? ডাক্তারদাদা বললো।
দেখতে পাচ্ছ না। বাবু সক্কাল সক্কাল উঠে ধোপ দুরস্ত হয়ে কেটে পরার ধান্দা করছেন।
সুরো চেঁচাল।
তোর সবেতে সন্দেহ। যা চা কর। বান্ধবী ফিরেছে?
না।
সুরো পা দাপাতে দাপাতে চলে গেল। বুঝলাম বড়োমা নির্ঘাৎ মন্দিরে পূজো দিতে গেছে।
তুই একবারে রেডি?
ডাক্তারদাদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
মাথা দোলালাম।
যা ঘরে গিয়ে বোস, আমরা যাচ্ছি। একসঙ্গে চা খাব।
আমি ও ঘরের উদ্দেশ্য হাঁটতে শুরু করলাম। বৌদি, ছোটোমা দু-পাশে।
এই পাঞ্জাবীটা কোথা থেকে পেলি?
তোমাদের সত্যি কথা বললে সন্দেহ করবে, মিথ্যে কথা বললে তো কথাই নেই।
তুই সব সময় সেরকম পরিবেশ তৈরি করে রাখিস তাই।
আলমাড়িটা খুলে হাতের সামনে অনেক পাঞ্জাবী দেখলাম। কালারটা ভাল লাগল টেনে বার করলাম।
ছোটোমা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
এ ঘরে এসে ঢুকতেই দেখলাম সুরো রান্নাঘরে খুটখাট করছে। আমি সোফায় আরাম করে বসলাম। সব ফাঁকা ফাঁকা। এতো লোক গেল কোথায়?
সুরো।
বলে ফেলুন।
বুঝেছি তুই এখনও আমার ওপর গরম খেয়ে আছিস।
সুরো চুপ করে রয়েছে।
পুঁচকে দুটো ওঠেনি?
উঠেছে।
সাড়া শব্দ পাচ্ছি না।
বড়োমার সঙ্গে গেছে।
আর সবাই।
প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।
বাবাঃ তুই ত ঘন ঘন দাঁড়ি টেনে দিচ্ছিস।
কমা, সেমিকলন স্টকে নেই তাই।
বৌদি জোড়ে হেসে উঠলো।
এখন চা খাবে?
না। ডাক্তারদাদা বললো, তুই গিয়ে বোস একসঙ্গে চা খাব।
সাত তাড়াতাড়ি চা করতে বললে কেন।
তোর সঙ্গে কথা বলা যাবে না। সক্কাল সক্কাল তুই খুব পিকআপে আছিস।
বাইরের গেটে গাড়ির হর্ণ বাজতেই ছোটোমা দে ছুট।
বারান্দা থেকেই জোরে চেঁচাল। দিদি চলে এসো, ওরা এসে গেছে।
সুরো রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো। গেটের কাছে গিয়ে পেছন ফিরে আমার দিকে তাকাল।
তুমি আসবে না?
আমি হাসছি।
এসো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
দিদাই বাবা কোথায়?
পিসী মামা ওঠে নি?
ছোটোমার হাসির শব্দ শুনতে পেলাম।
বলো না।
আফতাবভাই-এর গলা পেলাম। ইংরাজীতে বলছে।
কেমন আছেন দাদা। কেমন আছেন ডাক্তারবাবু। আন্টি কোথায়?
এই যে আমার কাছে। দিদির গলা পেলাম।
ছোটোমা, আজ আমি অনিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবো। আপনারা কেউ ডাকবেন না। ওকে একটা সারপ্রাইজ দেব। দেখ আমিও পারি।
ছোটোমা বৌদি দুজনেই জোড়ে হেসে উঠলো। হয়তো ইশারায় কিছু বলেছে।
ব্যাটা উঠে পড়েছে!
আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
মাঠের মধ্যে পর পর গাড়ি দাঁড়িয়ে পরেছে। বাইরেও বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। মনে হচ্ছে সাদা পোষাকের পুলিশও আছে।
তনু-মিত্রা দুজনকেই দেখতে পেলাম ভিড়ের মধ্যে সবাইকে সামলাচ্ছে। মিলি, টিনা, অদিতিকেও দেখতে পাচ্ছি।
বাড়ি শুদ্ধ সকলে উজার করে চলেগেছে।
গাড়ি থেকে একে একে মাল পত্র নামছে। চেনা অচেনা অনেক মানুষের ভিড়।
আফতাবভাই আমাকে দেখতে পেয়েগেছে। বড়ো বড়ো পা ফেলে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি পায়ে পায়ে শিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলাম। সুরো বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো।
আফতাবভাই কাছে এসে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে লাগছে। মুহূর্তের মধ্যে মুখটা কেমন ভেঙে চুড়ে দুমড়ে গেল। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঠাট উর্দুতে বলে উঠলো।
আমি বেঁচে থাকতে তোর এরকম হবে এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।
গলাটা কেমন ধরা ধরা।
আমিও আফতাবভাইকে জড়িয়ে ধরেছি।
দুজনে দুজনের কাঁধে মুখ গুঁজে দিয়েছি। চোখ বন্ধ।
চারিদিক কি হচ্ছে দুজনের কেউ কিছু জানি না। দুজনে দুজনের নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ।
ছোড়ো। রোতা কিঁউ। আভি তুম উসকা সামনে খাঁড়া হো। আব তক জো কুছ হুয়া আপনা হাত ক্ষতম করো। ছোড়না মত।
আমার পিঠে নরম হাতের স্পর্শ।
আফতাবভাই আমাকে ছাড়েনি দিদি জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। চোখ ছল ছল করছে।
দেখো দেখো উসকা শির কিতনা লম্বাতক ফাড়া হ্যায়।
আফতাবভাই আমার মাথাটা বুকে টেনে নিল। লম্বাকরে কাটা জায়গাটায় আঙুলের স্পর্শ করল। সারাটা শরীরে কেমন শিহরণ অনুভব করলাম। সিরসির করছে জায়গাটা। একটু যেন কেঁপে উঠলাম।
বুক থেকে মুখ তুললাম। চোখে চোখ। আফতাব ভাই-এর চোখের কোলে জল চিক চিক করছে।
খুব আস্তে আস্তে মাথাটা বাঁদিক থেকে ডান দিকে দোলাচ্ছে। ছলছল চোখের ভাষায় পরিবর্তনের আভাস।
আমি ঠিক আছি।
এতক্ষণে আমার গলায় শব্দ বেরলো। হয়তো গলাটা ধরে এসেছিল। আফতাবভাই আবার আমাকে বুকে টেনে নিল।
চলো ভেতরে যাই।
দিদি আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে আছে। আমিও দিদিকে একটা হাতে জড়িয়ে ধরে আছি।
আফতাবভাই আমার আর একটা হাত শক্ত করে ধরেছে। তিনজনে ধীরপায়ে হাঁটছি।
কখন বেরিয়েছ?
চারটে। দিদি বললো।
রাতে ঘুমওনি!
আগে আগে শুয়ে পরেছি।
বসিরকে দেখতে পাচ্ছি না।
বুঁচকির কাছে তোর কথা শুনে আমার থেকেও ওর মন বেশি খারাপ। আফতাবভাই বললো।
আমরা শিঁড়ির কাছে এলাম। সুরো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। একদৃষ্টে আমাদের দিকে তাকিয়ে। চোখের পলক পরছে না। বুঝলাম ও মাঠে নামেনি।
এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমাকে, আফতাবভাইকে, দিদিকে দেখছিল।
কাছে এগিয়ে আসতেই চোখদুটো কেমন ছল ছল করে উঠলো।
আফতাবভাই সুরো।
আফতাবভাই আমার হাতটা ছেড়ে সুরোকে বুকে টেনে নিল।
সুরোর ছোটোখাটো চেহারাটা আফতাবভাই-এর ওই বিশাল চেহারার মধ্যে হারিয়ে গেল।
সুরো ত্রস্ত হরিণীর মতো কেঁপে কেঁপে উঠলো।
আফতাবভাই নিজের বিশাল বুক থেকে সুরোর মুখটা তুলে ধরলো। চোখ ছল ছল করছে।
অনি আমার ভাই। তুই আমার বোন। কাঁদছিস কেন?
দিদি ওখানে দাঁড়িয়ে নিজের মুখে যে কথাটা বললো তা করে দেখাতে পারবে।
কেউ যেন আফতাবভাই-এর গালে সজোরে একটা থাপ্পর কষাল। ক্ষণিকের বিদ্যুৎ শিহরণে আফতাবভাই-এর মুখ চোখ কেমন পাংশু বর্ণের আকার ধারণ করলো। সুরোর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। চোখের পলক পরছে না।
সুরোর কান্নাভেঁজা চোখে আগুন।
দিদি সুরোর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। চোখে বিষ্ময়। এ কি কথা বললো সুরো!
আফতাবভাই-এর চোখে মুখের চেহারায় কাঠিন্য ফুটে উঠলো।
তোকে আমি বোন বলে স্বীকার করে নিয়েছি। দাদার কাছে তুই চেয়েছিস। তোকে তোর দাদা খালি হাতে ফেরাবে না। আফতাবভাই-এর গলাটা ভীষণ কর্কশ শোনাল।
চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চোখে বিষ্ময়।
সুরো আফতাবভাই-এর বুকে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
দাদার অনেক কষ্ট। কাউকে কিছু বলে না। বাবাও কিছু করতে পারেনি।
আমি আর দিদির চোখে চোখ রাখতে পারলাম না। মাথা নীচু করে নিলাম।
আফতাবভাই সুরোকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
সুরোর কথা শুনে সারাটা বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কারুর মুখে কোনও কথা নেই।
দাদা তোমাদের সব কথা বলে না। সুরো কাঁদতে কাঁদতেই বললো।
তুই কাঁদিস না সুরো। দিদি সুরোর পিঠে হাতে রেখেছে।
দিদি আমার মুখের দিকে তাকাল। থম থমে মুখ। চোখ দিয়ে আগুন ঝড়ে পরছে।
আফতাবভাই চোখ খুললো। সুরো তখনও আফতাবভাই-এর বুকে মুখ লুকিয়ে।
সুরো।
সুরো আফতাবভাই-এর বুক থেকে মুখ তুললো। চোখের পাতা জলে ভিঁজেগেছে। আফতাবভাই নিজের আঙুলের স্পর্শে সুরোর চোখর জল মুছিয়ে দিল।
এবার একটু হাস।
সুরো কান্নাভেঁজা চোখে হাসার চেষ্টা করলো, পারলো না।
যা একটু চা করে নিয়ে আয়। অনি, আমি তোর ঘরে বসবো।
মিত্রা। আফতাবভাই চেঁচিয়ে উঠলো।
সারাটা বাড়ি আফতাবভাই-এর গলার স্বরে অনুরণণ সৃষ্টি হলো।
বলো।
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম মাঠে জনারণ্য। সাগির, অবতার, লক্ষী সবাই এসেছে। মিত্রা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।
বড়োমাকে দেখছি না।
পূজো দিতে গেছে।
মাসীমনি?
মাসীমনি, জ্যেঠিমনি সবাই। ফোন করেছি এখুনি চলে আসবে।
অনিমেষদা, বিধানদাকে এই ভিড়ের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না। রাঘবনের আসার কথা ছিল। ওকেও দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে কি ওরা আসে নি?
হবে হয়তো।
অনিকা, অনিসাকে দেখতে পেলাম। তনু, মিত্রার পাশে দাঁড়িয়ে। মনে হয় এরিমধ্যে সংক্ষেপে সমস্ত ব্রিফ করে দিয়েছে। বসিরকেও দেখতে পেলাম। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
ইশারায় কাছে ডাকলাম। মাথা নীচু করে নিল।
কনিষ্ক, নীরুদের দেখতে পাচ্ছি না। রতন, আবিদরাও বেপাত্তা। নেপলা এদের সঙ্গে আসবে বলেছিল গেল কোথায়?
চল। আফতাবভাই আমার হাতটা ধরলো।
এই ঘরে বসি চলো। দিদিরা বরং ওই ঘরে চেঞ্জ করে নিক।
দিদি আমার কথা শুনে হাসছে।
তুই বহুত চালাক। আফতাবভাই হাসছে।
তুমি হচ্ছ সিন্ধুক, দিদি চাবি।
ঠিক আছে, চাবি হারিয়ে যাবে।
আমার কাছে সিন্ধুক খোলার ডুপ্লিকেট চাবি আছে।
সবাই হেসে উঠলো।
দাদা, ডাক্তারদাদা, আন্টি বারান্দায় উঠে এসেছে।
আমরা সবাই এ ঘরে এলাম।
আফতাবভাই চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে।
এটা তোমার রাজপ্রাসাদ নয়।
নাজমা।
বলো।
অনি বাজে কথা বলছে।
বলতে দাও।
আমি হাসছি।
মল্লিক।
বলুন। মল্লিকদা কাছে এগিয়ে এলো।
তুমি ছোটোমাকে ঠিক ঠিক দেখছ না। শেষবার ছোটোমাকে যেমন দেখেছিলাম তার থেকে শরীরটা খারাপ হয়েছে।
ছোটোমা মাথা নীচু করে হাসছে।
অনি এতো গণ্ডগোল করলে কার শরীর ঠিক থাকে।
ঠিক আছে অনির গণ্ডগোল সব বন্ধ করে দেব। তাহলে ছোটোমার শরীর ঠিক থাকবে।
মল্লিকদা হাসছে।
সবাই সোফায় বসেছে।
আমি চেয়ারে বসলাম।
বড়ো সোফাটায় আফতাবভাই রাজকীয় চালে হাতপা ছড়িয়ে বসেছে। দিদি আর একপাশে।
ডাক্তারবাবু ওখান থেকে ফিরে আসার পর আপনার সঙ্গে এতবার কথা হলো, আপনি একবারও আন্টির কথা বলেন নি। বুঁচকি গিয়ে বলতে জানতে পারলাম।
ডাক্তারদাদা লজ্জা পেয়ে গেছে।
এটা কি বলার মতো একটা বিষয়।
অবশ্যই। না হলে আমি চারটে বিয়ে করতাম। একটা বিয়ে করতাম না। অনির কাছে এই বিদ্যেটা শিখেছি। আপনি জানেন আমাদের ধর্মে এটার স্বীকৃতি আছে।
ডাক্তারদাদা হাসছে।
ওর কাছে আর একটা জিনিষ শিখেছি। সংযম। একসময় খুব উচ্ছৃঙ্খল জীবন লিড করেছি। নাজমা সেই সময় ফেডআপ। তারপর অনি আমাদের দুজনের জীবনে এলো। ওকে আঁকড়ে ধরে নতুনপথে নতুনভাবে বাঁচতে শিখলাম।
বিশ্বাস করুণ অনি আসার পর আমার ব্যবসা একশোগুণ বারিয়েছি। ওই-ই জোড় করে বসিরকে লণ্ডনে পাঠিয়ে দিল। প্রথমে তনু সুন্দরের কথা জানতাম না। পরে জানলাম।
সুরো কাছে এসে দাঁড়াল।
আফতাবভাই ওর মুখের দিকে তাকাল।
চা নিয়ে আসি।
নিয়ে আয়। মিলি বেটি।
মিলি রান্নাঘরের সামনে থেকেই সারা দিল।
বলো।
কনিষ্ক এলো না?
মাসীমনির সঙ্গে আছে।
অনিকা, অনিসা ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আফতাবভাই ইশারায় কাছে ডাকলো। আমি চারদিকটা লক্ষ্য করে যাচ্ছি। এই কদিনেই ওরা বেশ ক্ষুরধার তৈরি হয়ে গেছে।
দুজনেই আমার দিকে চোরা চাহুনি মেলে তাকাল।
কাছে এসে ফিস ফিস করে কি কথা বললো। আফতবভাই শুধু ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে আবুর নামটা উচ্চারণ করলো। ওদের আর কিছু বলতে হলো না। মাথাটা দুলিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলেগেল।
আঙ্কেল তারস্বর চিৎকারে গেটের দিকে তাকালাম।
সুরো, মিলি চায়ের ট্রে নিয়ে এসেছে।
মাম্পি-মিকি গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একবার চারদিকটা দেখে নিয়ে সুর সুর করে আমার কোলে এসে ঢুকে পরলো। আফতাবভাই, দিদি দুজনে ওদের চেয়ে চেয়ে দেখছে। ইশারায় আমাকে মাথা নীচু করতে বললো। দুজনে দুকানে ফিস ফিস করছে।
এমন ফিসফিসানি সবাই শুনলো। সুরো চা দিতে দিতে জোড়ে হেসে উঠলো।
ডাক্তাররদাদা, দদা, আন্টিও হাসছে।
ওরা কি বলছে সুরো। আফতাবভাই বললো।
ওদের আঙ্কেলকে তোমরা ধরে নিয়ে যেতে এসেছ কিনা।
আফতাবভাই কথাটা শুনে কেমন গুম হয়েগেল। সুরোর দিকে স্থির চোখে তাকাল।
সুরো বুঝতে পেরে গেছে। চোখ নামিয়ে নিল।
আফতাবভাই আস্তে করে বললো, তুই একবার ভেবে দেখ ওইটুকু দুধের শিশুও বোঝে।
পরিবেশটা আবার কেমন থম থমে হয়ে গেল।
বসির যখন ওদের মতো বয়স সেই সময় অনির সঙ্গে আলাপ। মেয়েটা সবে হয়েছে। তেলের….।
আবার বক বক করে। আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম।
দিদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করলো।
চা খাবে?
মাম্পির দিকে তাকালাম।
তুই খাবি?
মাথা দোলাচ্ছে।
আফতাবভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ইশারায় বললাম চায়ের কাপটা টেবিলে রাখো।
আফতাবভাই, দিদি তাই করলো।
যা টুপি আঙ্কেলের কাছ থেকে চা খা। মিকিকে বললাম।
মিকি দেখ আঙ্কেলটা মাথায় হেয়ারব্যান বেঁধেছে। মাম্পি চেঁচিয়ে উঠলো।
দুজনেই ছোট্ট শরীর দুটো দুমড়ে মুচড়ে হাসছে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে দুজনের মাঝখানে এসে বসলাম। ওরা আমাকে জড়িয়ে রয়েছে।
আমি একটা ডিসে দুজনের কাপ থেকে একটু একটু করে চা ঢাললাম।
তুই কোন কাপটা নিবি এটা না ওটা। মাম্পিকে বললাম।
মাম্পি আফতাবভাই-এর কাপ দেখাল।
তার আগেই মিকি কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে শুরু করে দিয়েছে।
মিকি আমারটা বেশি।
আমারটা।
দেখলাম আফতাবভাই বিড় বিড় করছে।
হাসলাম, মুখস্থ করছো?
আফতাবভাই হাসছে। আমি ওদের কথার ইংরেজী তর্জমা করলাম।
দুজনে আরও জোড়ে হেসে উঠলো।
মাম্পি আফতাবভাই-এর দিকে চোখ মুখ পাকিয়ে বললো, খাও।
আফতাবভাই হাসছে।
বড়োমা ঘরে ঢুকেলো। চোখ দুটো গোল্লা গোল্লা।
তোরা ওখানে কি করছিস!
তারপর সুরোর দিকে তাকিয়ে বললো।
এখুনি চারটে করে কচুরি খেয়ে এসেছে। রতন কিছুতে দেবে না। ওর পা ধরে ঝুল পেরে সে কি কান্না। প্যান্ট খুলে দেওয়ার জোগাড়।
পেছনেই দেখলাম জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি। তার পেছনে রতন, আবিদ।
সবাই হাসছে। আমি আফতাবভাইকে ব্যাপরটা বোঝাতেই আফতাবভাই জোড়ে হেসে উঠলো।
দেখলাম অনিসা, অনিকা মাসিমনির চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে ভেতরে এলো।
আফু আঙ্কেল, ঠাম্মা। অনিসা আফতাবভাই-এর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আফতাবভাই, দিদি দুজনেই উঠে দাঁড়িয়েছে। সোফা ছেড়ে এগিয়ে গেল। আমি সোফাতেই বসে আছি। বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। বুঝলাম ঢুকতে না ঢুকতেই রিপোর্ট পেশ হয়েছে।
কনিষ্ক, নীরু, বটা অনিকেত সবাই ভেতরে এসেছে।
আফতাবভাই নিশ্চই মাসিমনির পায়ে হাত দিতে চাইছিল। মাসিমনি ওদের হাতটা ধরেছে। কথা বলছে। চারদিকে ক্যাঁচর ম্যাচর এখান থেকে কিছুই বুঝতে পারছি না। কনিষ্করাও আফতাবভাই-এর সঙ্গে কথা বলছে। বুঝলাম অনিকা, অনিসা সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছে।
ওরা দুজন মাসীমনির চেয়ারটা ঠেলে ঠেলে টেবিলের কাছে নিয়ে এলো।
আফতাবভাই, দিদি দুজনে আবার সোফায় এসে আমার দুপাশে বসলো। দুজনের মুখ নরছে। বড়োমা মনে হয় প্রসাদ দিয়েছে। মাম্পি, মিকি তখনও চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে চলেছে।
সন্দেশ খাচ্ছ।
মাম্পি তাকাল আফতাবভাই-এর দিকে।
আফতাবভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ছে। আবার ইংরাজী তর্জমা করলাম।
দুজনে হাসে।
আঙ্কেল, দাড়ি দাদাই এততো সন্দেশ দিয়েছে, খাবে?
আবার আমি তার ইংরাজী তর্জমা করলাম।
দাড়ি দাদাই কে অনি? দিদি বললো।
ইকবালভাই।
আবার দুজনে হাসে।
বড়োমা মসজিদে গেছিল! আফতাবভাই বললো।
হবে হয়তো।
দেখলাম দুজনেই জামায় হাত মুছতে শুরু করেছে।
সুরো রে রে করে তেরে এলো।
আফতাবভাই ওর হাতটা ধরে ফেললো।
সুরো হাসছে।
তুমি জানো না অনিদার জন্য….।
হোক। বসিরও একদিন এরকম ছিল। আজ দেখ।
আফতাবভাই টেবিলে রাখা কাপটা তুলে ঠোঁটে ছোঁয়াতে গেল। সুরো আবার চেঁচিয়ে উঠলো।
এ কি করছো! তুমি ওটা খাবে না, আমি এখুনি বানিয়ে দিচ্ছি।
না সুরো এটা আমি আর তোর বৌদি খাই। তুই নতুন করে বানিয়ে দে, আবার খাব। এটা নষ্ট করবো না।
দিদি মুচকি মুচকি হাসছে।
তুই রাগ করলি?
সুরো, আফতাবভাই-এর দিকে তাকিয়ে, সবাই তাকিয়ে আছে।
হ্যাঁরে সুরো, আমার টোটাল ইন্ডাস্ট্রির যা ভ্যালুয়েসন তার থকেও এর মূল্য আমার কাছে বেশি।
আফতাবভাই নিজেই ঠান্ডা চা এক চুমুকে খেয়ে নিল।
আমি প্লেটের চা অনেক আগেই খেয়ে নিয়েছি।
আফতাবভাই কাপটা সুরোর দিকে এগিয়ে দিল।
তুই বানিয়ে দে আবার খাচ্ছি।
সুরো চোখ নামিয়ে নিল।
জানেন ডাক্তারবাবু একটা সময় নিজের খুব অহংকার ছিল। পয়সার অহংকার, ক্ষমতার অহংকার। অনি আমার সেই অহংকার বাক্সে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে দিয়েছে।
আপনাকে লণ্ডনে থাকতেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম আপনার যে ভাবে চলা-ফেরা করা উচিৎ আপনার চাল-চলন ঠিক সেরকম নয়।
আফতাবভাই হাসলো।
অনির সঙ্গে আপনার পরিচয়টা কিভাবে হয়েছিল। আপনি বলেন নি। যতবার জিজ্ঞাসা করেছি আপনি এড়িয়ে গেছেন।
আমি আফতাবভাই-এর মুখের দিকে তাকলাম।
মন খারপ করবো না। তুই বিশ্বাস কর।
দেখলাম মাসিমনি একদৃষ্টে আমাদের দিকে তাকিয়ে। দিদি মাথা নীচু করে রয়েছে।
নেপলা, সাগির, অবতার কম পয়সার মালিক নয়। তিনজনেরটা যোগ করলে হাজার দুএক-কোটি হবে। ওদের চাল-চলন দেখলে বোঝা যায়।
দাদার চোখদুটো কেমন ছোট ছোট হয়ে গেল।
আমিও মাঝে মাঝে প্রয়োজন পরলে ওদের কাছ থেকে ধার নিই।
ডাক্তারদাদা মুচকি হাসলো।
ওরা অনির সঙ্গে ওখানে গেছে। অনিকে ওরা আগে থেকে চিনতো।
অনি ওদের যখন ট্রেণিং দেয়, সেই সময় আমাকেও একটু আধটু দিয়েছিল। তবে আমার থেকেও নজমা ওকে ভীষণ ট্রাস্ট করতো।
ঘরের সবাই শ্রোতা। একমাত্র বক্তা আফতাবভাই।
অনিকা, অনিসা, সুন্দররাও সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে।
তখন নেপলা হাসপাতালে ভর্তি। ওর খুব শরীর খারাপ। হয়তো রক্তের দরকার পরেছিল অনি দিয়েছিল। প্রায় মাস তিনেক নেপলা হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ইন দ্যাট প্রিয়েড আমার মেয়েরও ওই গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু স্টকে নেই।
রেজিস্টার্ড দেখে জানাগেল ওই গ্রুপের রক্ত নেপলাকে দেওয়া হয়েছিল। পরে জেনেছিলাম ও সর্বদাতা গ্রহীতা নয়। আমার মেয়েরটাও তাই ছিল।
পেসেন্ট হিসাবে নেপলা তখন হাসপাতালে, ওর কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি অনি দিয়েছে। নেপলাকে ব্যাপারটা বলতে সাগির গিয়ে অনিকে ধরে নিয়ে এলো।
তখন ওর একমুখ দাড়ি গেড়ুয়া বসন। চুলে তখনও জট পরেনি। পুরো সাধুবাবা।
প্রথমটায় একটু অবাক হয়েছিলাম।
আলাপ পরিচয় হওয়ার পর ওকে সব কথা বলতে এক কথায় রাজি হয়ে গেল।
নাজমাকে দিদি বলে ডাকলো। বাচ্চাটাকে কোলে নিল।
প্রথমদিনই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম। বাচ্চটা খুব কাঁদতো। কিন্তু ওর কোলে থাকলে, কেমন যেন নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজে ঘুমিয়ে থাকত।
ও রক্ত দিল।
আমার মেয়ের তখন মাস সাতেক বয়স।
রক্ত দেওয়ার পর ওকে টাকা অফার করলাম।
দাদা জোড়ে হেসে উঠলো।
সারাটা ঘর নিস্তব্ধ একমাত্র দাদা হাসছে।
আফতাবভাই দাদার মুখের দিকে তাকিয়েছে।
তখনই ও তোমাকে বোমা মারলো।
হ্যাঁ দাদা সাধারণ বোমা না।
কি বললো?
বললো, তোমার টাকা দেওয়ার যখন ইচ্ছে, তাহলে তোমার প্রপার্টির যা ভ্যালুয়েসন সেই ভ্যালুয়েসন অনুযায়ী টাকা দাও। বেশি না জিরো পয়েন্ট টু-পার্সেন্ট।
কথাটা শুনে আমি কেমন একটু থমকে গেছিলাম। অনেকক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বোঝার চেষ্টা করলাম। ওর কিন্তু কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। একটু থেমে বললো।
তোমার বিজনেসের ব্যালেন্সসিটটা দেবে, আমি তোমার ক্যাপিটেলটা একবার দেখে নেব।
তখন বুঝলাম সাধুবাবা নিছক সাধুবাবা নয়। ব্যালেন্সসিট দেখে যে ক্যাপিটেল ক্যালকুলেসন করে সে খুব একটা সাধারণ হবে না।
দাদা ডাক্তারদাদা হাসছে।
প্রথমে ভেবেছিলাম সাধুবাবা আমার সঙ্গে ইয়ার্কি ফাজলামো মারছে।
আমার মুখ চোখ দেখে কি বুঝল কি জানি, আমাকে মিঃ ফোর্ড আর স্বামী বিবেকানন্দের একটা গল্প বললো।
আমি ওর মুখে গল্পটা শুনে পুরো স্টান্ট হয়েগেলাম। রকফেলার ফাউন্ডেসন, ফোর্ড ফাউন্ডেসন বিবেকানন্দের মস্তিষ্ক প্রসূত এটা জানতামই না।
সেদিন ও আর দাঁড়ায় নি। চলেগেল। আমাকে অবজ্ঞা করে ওর ওই চলে যাওয়াটা আমার অহংবোধে ভীষণ আঘাত করেছিল। কিন্তু যেহেতু ও আমার মেয়েকে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছে, আমি মুখে কিছু বললাম না।
সেবারের মতো মেয়ে সুস্থ হলো। নেপলাও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলো।
আমি নেপলা, সাগির, অবতারের কাছ থেকে ওর সম্বন্ধে কিছু কিছু জানতে পারলাম।
তাও কি ওরা সব বলে। এটুকু বুঝলাম তিনজনে বেশ শেয়ানা। মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে।
নাজমা বাড়িতে এলো।
ওর মুখ থেকে শুনলাম অনি নাকি নিয়ম করে আমার মেয়েকে দেখতে আসতো।
দু-রাত হাসপাতালে জেগেছে।
সত্যি কথা বলতে কি সেই সময় আবু সব দেখা শুন করেছে।
আবুও দেখলাম ওর প্রেমে পড়ে গেছে।
একদিন আমি ঘটনাটা আমার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। শুনে ওরাও অবাক।
কেন জানিনা ওকে ঠিক সবার সঙ্গে মেলাতে পারলাম না।
ও বলার আগে কোনওদিন বিবেকানন্দের নাম শুনি নি। ও বলার পর আমার ইন্ডিয়ান বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে একদিন রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বিবেকানন্দের পুরো সেট কিনলাম। যতো পড়ি তত যেন অথই সাগরে ডুবে যাই।
ওরা তিনজন কিন্তু মাঝে মধ্যে আমার কাছে আসতো। অনি কিন্তু একদিনও আসে নি।
একদিন ওদের ফ্ল্যাটে গেলাম।
দেখলাম নেপলাদের ও পড়াচ্ছে। অবাক হলাম।
(আবার আগামীকাল)
Leave a Reply