
দীনেন্দ্র কুমার রায়
‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা’ আক্বর শাহের পরলোকগমনের অব্যহিত পরেই যুবরাজ সেলিম পাতশাহ ‘নূরউদ্দীন জাহাঙ্গীর’ খেতাব গ্রহণপূর্ব্বক ভারত-সাম্রাজ্যেশ্বর রূপে অভিষিক্ত হইলেন। জাহাঙ্গীর শাহের অভিষেক কার্য্য আগ্রা নগরে মহা সমারোহে সুসম্পন্ন হয়। ‘মহা সমারোহ’ শব্দ দ্বারা সেই বিরাট্ মহোৎসবের ধারণা হয় না, কারণ একালে বৃটিশ সম্রাটের অধীন একজন সামান্য মিত্র-রাজ্যের অভিষেক-কার্য্যও ‘মহা সমারোহে’ সুসম্পন্ন হইয়া থাকে।
কোনও নূতন সম্রাটের রাজ্যাভিষেকে সে কালে উৎসব ও আনন্দ যেরূপ দেশব্যাপী হইত, একালে পৃথিবীর প্রায় কোনও দেশেই সেরূপ হয় না। প্রজা-সাধারণের হিতানুষ্ঠানই সেকালে রাজা মহারাজগণের অভিষেকোৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিল। সম্রাট্ জাহাঙ্গীরের অভিষেকে প্রজার মঙ্গল সাধনের জন্য যেরূপ বিপুল অর্থ ব্যয় করা হইয়াছিল, অন্য কোন্ও সম্রাট্ স্বীয় অভিষেক-মহোৎসব স্মরণীয় করিবার জন্য তত অধিক অর্থব্যয় করেন নাই।
সম্রাট্ জাহাঙ্গীরের অভিষেক-ক্রিয়া যথারীতি সুসম্পন্ন হইলে আগ্রার সম্রাট্-দরবারে সম্রাট্ দূত উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিলেন, ‘আমাদের সম্রাট্-জাহাঙ্গীর পৃথিবীপতি হউন। সম্রাট্ তাঁহার এই অধম ভৃত্যকে এ কথা ঘোষণা করিতে আদেশ করিয়াছেন যে, তাঁহার অভিষেক স্মরণীয় করিবার জন্য রাজ্য মধ্যে এক লক্ষ ইদারা খনন করা হইবে, এবং পান্থগণের সুখস্বচ্ছন্দতা বর্দ্ধনের নিমিত্ত প্রধান প্রধান পথের ধারে পঞ্চাশ সহস্র পান্থনিবাস প্রতিষ্ঠিত হইবে। শুষ্ক আদায়ের জন্য ভবিষ্যতে কোনও পণ্যদ্রব্যের গাঁট খুলিবার প্রথা রহিত হইল। ছয় মাস কাল প্রজাবর্গকে কোনও প্রকার রাজকর প্রদান করিতে হইবে না। দরিদ্র ও রুগ্ন প্রজাগণের চিকিৎসার জন্য সম্রাটের ব্যয়ে চিকিৎসকগণকে নিযুক্ত করা হইবে। মদ্যবিক্রয় করা রহিত হইল। ছয় মাস ধরিয়া দিবারাত্রি দীনদরিদ্রগণকে অন্নদান করা হইবে। সম্রাট আমাকে একথাও ঘোষণা করিতে আদেশ দান করিয়াছেন যে, যাহারা অন্য কর্ত্তৃক উৎপীড়িত হইবে বা যাহাদের কোনও প্রকার অভিযোগ থাকিবে-তাহারা যদি প্রতিকারপ্রার্থী হইয়া সম্রাটের প্রাসাদ-বহির্ভাগে সংরক্ষিত স্বর্ণ-নির্ম্মিত ঘণ্টার রজ্জু আকর্ষণ করে তাহা হইলে সম্রাটের নিকট তাহারা সুবিচার লাভ করিবে। আসুন আমরা সকলে প্রার্থনা করি, সম্রাটের রাজত্বকাল সমুজ্জল গৌরব-রবি-করে ভাস্বর হউক, এবং বিজয়-নক্ষত্র সমগ্র পৃথিবীর উপর তাহার আলোকচ্ছটা বিকীর্ণ করুক।’
সাম্রাজ্যের আবালবৃদ্ধবণিতা সম্রাটের এই ঘোষণা শ্রবণ করিয়া আনন্দে উৎফুল্ল হইয়াছিল। তাঁহার ঘোষণা যে স্তোকবাক্য মাত্র ইহা কাহারও মনে করিবার কারণ ছিল না। পিতৃসিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হইয়া সম্রাট্ জাহাঙ্গীর প্রত্যহ দিবসের অধিকাংশ কাল প্রজাবর্গের অভিযোগ শ্রবণ করিতেন; তিনি ন্যায় বিচার বিতরণে কোনও দিন কুণ্ঠিত ছিলেন না। ধনী দরিদ্র সকলেই যাহাতে অবাধে তাঁহার নিকট বিচারপ্রার্থী হইতে পারে এই অভিপ্রায়ে তিনি প্রাসাদবহির্ভাগে সুবর্ণময় ঘণ্টা ঝুলাইয়া রাখিয়াছিলেন, সেই ঘণ্টার রজ্জু আকর্ষণ করিলেই ঘণ্টাধ্বনি হইত, সম্রাট্ অভিযোগকারীকে আহ্বান করিয়া স্বকর্ণে অভিযোগ শ্রবণ করিতেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় সকলে এই রজ্জু স্পর্শ করিতে পাইত না; রজ্জু আকর্ষণপূর্ব্বক সম্রাটের মনোযোগ আকৃষ্ট করা দূরের কথা, দরিদ্রেরা সেখানে ঘেঁসিতেও পাইত না। সম্রাটের প্রাসাদ-সংলগ্ন ঘণ্টা, তাহার রজ্জু আকর্ষন করিবার সাহসও সকলের ছিল না। এই রজ্জু-আকর্ষণ জন্য অভিযোগকারিগণকে রীতিমত তদ্বির করিতে হইত। তদ্বিরের ব্যবস্থা চিরকালই আছে-রীতিমত তদ্বির ভিন্ন একালেই বা কয়জন লোক মামলা মোকদ্দমার জয়লাভ করিতে পারে? তবে দেশভেদে, কালভেদে তদ্বিরের প্রকার-ভেদ হয়, একথা যথার্থ।
বিনা তদ্বিরে প্রাসাদরক্ষিগণকে যথারীতি পূজা না যোগাইয়া, কেহ ঘণ্টার রজ্জু স্পর্শ করিতে পারিত না বটে, কিন্তু দীন দরিদ্রেরা যে কখনও সম্রাটের নিকট বিচারপ্রার্থী হইতে পারিত না, এরূপ নহে। দরিদ্রের অভিযোগও তিনি কিরূপ আগ্রহের সহিত শ্রবণ করিতেন তাহার প্রতিপক্ষ প্রবল প্রতাপান্বিত মহা সম্ভ্রান্ত রাজকর্ম্মচারী হইলেও ন্যায়ের মর্য্যাদা রক্ষার জন্য তিনি অব্যর্থ বজ্রের ন্যায় কি ভাবে রাজদণ্ডের প্রয়োগ করিতেন, তাহার একটি কৌতূহলোদ্দীপক লোমহর্ষণ বিবরণ লিপিবদ্ধ করিতেছি।
সম্রাট্ যখন যুবরাজ ছিলেন, তখন তিনি আমোদপ্রিয় উন্মার্গগামী ব্যসনাসক্ত যুবক ছিলেন বলিয়া তাঁহার যতই দুর্নাম থাকুক, সিংহাসনে আরোহণ করিবার পর নিরপেক্ষভাবে রাজকার্য্য পর্য্যালোচনায় তাঁহার ত্রুটি ছিল না। একদিন ধীরভাবে বিশেষ মনোযোগ-সহকারে রাজকার্য্য নির্ব্বাহ করিতেছিলেন, এমন সময় প্রাসাদসংলগ্ন ঘণ্টা ঠুন্ ঠুন্ শব্দে বাজিয়া উঠিল। রাজকার্য্যে অতিনিবিষ্ট সম্রাটের দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ সেই দিকে আকৃষ্ট হইল। তিনি ঘণ্টাধ্বনি শ্রবণমাত্র তাঁহার সম্মুখে উপবিষ্ট একজন অমাত্যকে আদেশ করিলেন, ‘যাও বাহিরে গিয়া দেখ কে ঘণ্টা বাজাইল! যদি কোনও প্রজা উৎপীড়িত হইয়া আসিয়া থাকে তাহাকে আমার সম্মুখে হাজির কর।’
সম্রাটের আদেশ শ্রবণমাত্র অমাত্য গাত্রোত্থান করিয়া বহির্দ্দেশে গমন করিলেন এবং অবিলম্বে একটি বৃদ্ধকে তাহার বৃদ্ধা পত্নীসহ সম্রাট্সদনে উপস্থিত করিলেন। তাহারা অতি দরিদ্র, পরিধানে মলিন ছিন্ন বস্ত্র, তাহাদের দেহ অস্থি চর্ম্মসার, কোটরগত চক্ষু জ্যোতিহীন। তাহাদের মুখ বিষাদ-কালিমায় সমাচ্ছন্ন; তাহাদের নিদারুণ অন্তর্ব্বেদনা শোণিতসম্পর্কশূন্য পাণ্ডুর মুখে প্রতিফলিত হইতেছিল। তাহারা কম্পিতপদে সম্রাটের সম্মুখে আসিয়া তাঁহার অভয়প্রদ সিংহাসনের পুরোভাগে লুটাইয়া পড়িল, এবং ভূমি চুম্বন করিয়া সাশ্রুনেত্রে কাতরকণ্ঠে বলিল, ‘শাহান্শাহ, এই হতভাগ্যদের প্রতি প্রসন্ন হউন, দয়া করুন, বিচার-প্রাথনায় আমরা বহুদূর হইতে আসিয়াছি।’
সম্রাট বলিলেন, ‘তোমাদের কোনও ভয় নাই, শান্ত হও, উঠ, বল তোমাদের অভিযোগ কি। আমি তোমাদের অভিযোগ শুনিয়া সুবিচার করিব।’
বৃদ্ধ অভয়বাণী শ্রবণ করিয়া উঠিল, এবং দণ্ডায়মান হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে আবেগকম্পিত কণ্ঠে বলিল, ‘জাঁহাপনা চিরজীবী হউন।’- বৃদ্ধের মুখে আর কোনও কথা সরিল না, সে স্থানুর ন্যায় দণ্ডায়মান রহিল। বোধ হয় অভিযোগ করিতে তাহার সাহস হইতেছিল না। সে কাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতে আসিয়াছে-সে কথা স্মরণ করিয়া বৃদ্ধ ভয়ে বিহ্বল হইয়া উঠিল।
বৃদ্ধকে নীরব দেখিয়া একজন দরবারী বলিলেন, ‘তোমার কি নালিশ সংক্ষেপে বল; সম্রাটের অধিক কথা শুনিবার অবসর নাই।’
কিন্তু তথাপি বৃদ্ধের মুখে কথা বাহির হইল না, ভয়ে সে আড়ষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল। স্বামীর এই অবস্থা দেখিয়া বৃদ্ধা কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল,-’শাহান্শাহ, আমরা যে কথা বলিতে আসিয়াছি, সে কথা বলিতে আমাদের সাহস হইতেছে না! যিনি আমাদের প্রতি উৎপীড়ন করিয়াছেন, আমাদের অন্ধের নয়ন প্রাণাধিক পুত্রকে হত্যা করিয়াছেন, তিনি অসধারণ ব্যক্তি; তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থিত করা আমাদের পক্ষে কিরূপ ‘গোস্তাকি’ তাহা বুঝিয়া আমাদের মুখে কথা সরিতেছে না।’
সম্রাট জাহাঙ্গীর সুস্পষ্টস্বরে বলিলেন, ‘কাহার বিরুদ্ধে তোমাদের অভিযোগ আছে? নির্ভয়ে বল; তোমাদের উৎপীড়নকারী যদি আমার পুত্রও হয়, তাহা হইলেই ন্যায় বিচারে আমি কুণ্ঠিত হইব না।’
সম্রাটের নিকট আশ্বাস পাইয়া বৃদ্ধার ভয় ও সঙ্কোচ অনেকটা দূর হইল; সুবিচার পাইবে বুঝিয়া সে আশ্বস্ত হইয়া বলিল, ‘শাহান্শাহ, আমরা বহুদূর দেশ হইতে আসিয়াছি, বাঙ্গালা মুলুকে বর্দ্ধমানে আমাদের নিবাস, আমরা বড় গরীব, যানবাহন কোথায় পাইব? তাই মাসের পর মাস ধরিয়া পায়ে হাঁটিয়া এখানে আসিয়াছি, নিঃসস্বল অবস্থায় দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিতে করিতে আসিয়াছি; আমরা এরূপ দরিদ্র যে, আমাদের সঙ্গে দ্বিতীয় বস্ত্র নাই। সুবিচার পাই এই আশায় এত কষ্ট করিয়া রাজধানীতে আসিয়াছি!’
বৃদ্ধা ক্ষণকাল নীরব হইয়া পুনর্ব্বার বলিতে লাগিল, ‘জাঁহাপনা, আমরা দরিদ্র হইলেও সুখেদুঃখে কোন রকমে আমাদের দিনপাত হইতেছিল। দেশে আমাদের একখানি ঘর আছে, সামান্য কিছু জমিও অছে; আমাদের একটি শিশুপুত্র ছিল, সে আমাদের অন্ধের নয়ন, খঞ্জের যষ্টির মত ছিল, তাহার মুখ দেখিয়া, তাহার মধুমাখা কথা শুনিয়া আমরা হাসিমুখে সকল দুঃখকষ্ট সহ্য করিতাম; দুঃখকে দুঃখ বলিয়া মনে করিতম না। অর্থকষ্টেও আমরা কাতর হইতাম না। আহা, তাহার আমার কত রূপ, সেই ছেলে বয়সেই তাহার কত গুণ, বাছার মিষ্ট কথাগুলি এখনও আমার কাণে বাজিতেছে!’
শোকে বৃদ্ধার মুখে আর কথা সরিল না, তাহার উভয় চক্ষু হইতে দর দর ধারায় অশ্রু বিগলিত হইয়া তাহার শুষ্ক গণ্ডদ্বয় প্লাবিত করিল।
বৃদ্ধার সকরুণ কাহিনী শ্রবণ করিয়া সদাশয় সম্রাটের হৃদয় করুণার্দ্র হইয়া উঠিল। সভাসদ্বর্গ নীরব। সম্রাট্ বৃদ্ধাকে পুনর্ব্বার কোনও কথা বলিবার পূর্ব্বেই বৃদ্ধা আত্মসংবরণ করিয়া বলিতে আরম্ভ করিল, ‘জাঁহাপনা, আমার শিশুপুত্র একদিন রাজপথে খেলা করিতেছিল, সেই সময় আমাদের দেশের সুবাদার সৈয়ফ উল্লা বাহাদুর হস্তিপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া নগর-দর্শনে বাহির হইয়াছিলেন। বালক পথে খেলা করিতেছে তাহা দেখিয়াও তিনি দেখিলেন না, আমার শিশুপুত্রের উপর দিয়া হাতী চালাইয়া দিলেন। হাতী আমার ছেলেকে পদতলে পিষিয়া মারিয়া ফেলিল। আমরা শোকে দুঃখে অধীর হইয়া হস্তীর পশ্চাতে ধাবিত হইলাম, কাতরস্বরে সুবাদার সাহেবের নিকট বিচার প্রার্থনা করিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের প্রার্থনায় কর্ণপাত করিলেন না। সুবাদার সাহেবের সঙ্গে যে সকল ওমরাহ নগরভ্রমণে বাহির হইয়া ছিলেন, তাঁহারা আমাদিগকে উপহাস করিলেন, অশ্রাব্য কটুবাক্যে আমাদিগকে গালি দিলেন। একে নিদারুণ পুত্রশোক, তাহার উপর এই প্রকার দুর্ব্বাক্য; আমার বড় রাগ হইল, আমি জ্ঞানহারা হইয়া সুবাদার সাহেবকে গালি দিলাম। সুবাদার আমাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হইয়া আমাদের জমীজমা ঘর সমস্তই সরকারে বাজেয়াপ্ত করিয়া আমাদিগকে নগর হইতে তাড়াইয়া দিবার আদেশ করিলেন; সর্ব্বস্ব হারাইয়া আমরা পথে দাঁড়াইলাম, কিন্তু সুবাদারের অত্যাচারে সেখানেও আমাদের স্থান হইল না। নগরের পথ হইতেও আমরা বিতড়িত হইলাম।’
বৃদ্ধা আর কোনও কথা বলিতে পারিল না। শোকে দুঃখে অবসাদে সে সেই স্থানে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল। তাহার স্বামী তাহার পার্শ্বেই দণ্ডায়মান ছিল, সে বৃদ্ধার মাথা কোলে তুলিয়া লইয়া তাহার মূর্চ্ছা-ভঙ্গের চেষ্টা করিতে লাগিল।
এই শোচনীয় দৃশ্যে সম্রাটের হৃদয় ক্ষোভে দুঃখে আলোড়িত হইয়া উঠিল। তিনি সক্রোধে বলিলেন,’আমার সাম্রাজ্যে এমন অন্যায় কর্ম্ম করিতে কাহার সাহস হইল? আমি এই অত্যাচারের প্রতিবিধান করিব।’ অনন্তর তিনি একজন অমাত্যকে আদেশ করিলেন, ‘অবিলম্বে হুকুম নামা লেখ, আর এই দু’জনকে দশ মোহর খোরাকী দাও।’
অমাত্য তৎক্ষণাৎ বৃদ্ধকে দশটি স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করিলেন; বৃদ্ধ প্রথমে তাহা লইতে সম্মত হইল না, সে সুবিচার প্রার্থনায় সম্রাট্-সকাশে আসিয়াছিল, সম্রাট অনুগ্রহ পূর্ব্বক তাহার প্রার্থনায় কর্ণপাত করিয়াছেন, ইহাই তাহার পরম সৌভাগ্য, ইহার উপর আবার খোরাকীর ব্যবস্থা! কিন্তু বৃদ্ধা সম্রাটের এই দান প্রত্যাখান করিতে পারিল না। মোহর কয়টি তাহাকে লইতে হইল। অনন্তর অমাত্য সম্রাটের হুকুমনামা লিখিতে বসিলেন।
সম্রাটের আদেশে অমাত্য লিখিতে লাগিলেন, ‘সুবে বাঙ্গালার সুবাদার সৈয়ফ উল্লাকে এতদ্বারা জ্ঞাত করা যায় যে, তিনি স্বেচ্ছায় এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার পুত্রকে হত্যা করিয়াছেন, এবং তাহাদিগকে গৃহহীন করিযাছেন;-এজন্য পদচ্যুতি ও যথাযোগ্য শাস্তিই তাঁহার আচ্রণের উপযুক্ত কর্ম্মফল। কিন্তু এবার তাঁহার অপরাধ আমরা ক্ষমা করিতে প্রস্তুত আছি, তবে আমাদের আদেশ এই যে, সুবাদারের হস্তীর যে মাহুত এই অন্যায় কার্য্য করিয়াছে, তাহাকে তাহার অপরাধের উপযুক্ত দণ্ড দান করিবে, এবং এই বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার যে সম্পত্তি সরকারে বাজেয়াপ্ত করা হইয়াছে, তাহা তাহাদিগকে প্রত্যার্পন করিবে; আর তাহাদের যে ক্ষতি হইয়াছে, তাহার উপযুক্ত ক্ষতি পূরণ করিবে। আমার এই হুকুম তামিল করিতে বিলম্ব না হয়।’
হুকুমনামা লিখিত হইলে অমাত্য তাহা পাঠ করিয়া সম্রাট্কে শুনাইলেন। হুকুমনামার যথারীতি সহি ও মোহর করা হইলে তাহা বৃদ্ধার হস্তে প্রদান করা হইল। বৃদ্ধার তখন চেতনা সঞ্চার হইয়াছিল। এই হুকুমনামা লইয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক তাহা সুবাদারের হস্তে প্রদানের আদেশ করিয়া সম্রাট্ তাহাদিগকে আরও কিছু অর্থ প্রদান করিলেন, বলিলেন, এই টাকার তাহাদের যানবাহন সংগ্রহের সুবিধা হইবে।
বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা তাহাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের আশাতিরিক্ত ফললাভ করিয়া সম্রাট্কে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনপূর্ব্বক দরবার হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল; এবং গাড়ী ভাড়া করিয়া যথাসময়ে বর্দ্ধমানে উপস্থিত হইল। তাহারা সুবাদারের নিকট সম্রাটের হুকুমনামা প্রেরণ করিল।
সুবাদার নবাব সৈয়ফ উল্লা সম্রাটের ‘ফারমান’ পাঠ করিয়াই ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন। সম্রাটের হুকুমনামা তিনি তৎক্ষণাৎ খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেন, এবং বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে কারাগারে নিক্ষেপ করিতে আদেশ দিলেন; তাহাদিগকে জ্ঞাপন করা হইল, সম্রাটের নিকট অভিযোগ করিয়া তাহারা যে ‘গোস্তাকি’ করিয়াছে সে জন্য যতদিন পর্য্যন্ত তাহারা তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা না করিবে এবং তাঁহার প্রদত্ত দণ্ডই সঙ্গত দণ্ড বলিয়া স্বীকার না করিবে-ততদিন তাহাদিগকে মুক্তি দান করা হইবে না।
বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে কারাগারের একটি অন্ধকারপূর্ণ নির্জ্জন প্রকোষ্ঠে বন্দী করিয়া রাখা হইল। কারাধ্যক্ষ প্রত্যহ প্রভাতে তাহাদিগের নিকট উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিতেন-তাহারা অপরাধ স্বীকার করিতে প্রস্তুত আছে কি না, সর্ব্বশক্তিমান্ সুবাদারের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল নিষ্ফল, ইহা তাহারা বুঝিয়াছে কি না। কিন্তু বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা উভয়েই অবিচল, দুঃসহ নানা যন্ত্রণা সহ্য করিয়াও তাহারা ‘নরম’ হইল না, ভ্রমস্বীকার করিল না। তখন সুবাদার তাহাদিগকে অনাহারে রাখিবার আদেশ দিলেন। একে নিদারুণ কারাক্লেশ, তাহার উপর অনাহারের কষ্ট। বন্দিদ্বয় এত যন্ত্রণা সহ্য করিতে পারিল না, ত্রুটী স্বীকার করিয়া তাহারা সুবাদারের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করিল। তখন সুবাদার তাহাদিগকে কারাগার হইতে মুক্তিদান করিলেন।
কারাগার হইতে মুক্তিলাভ করিয়া তাহারা বর্দ্ধমানের সন্নিহিত কোনও পল্লীগ্রামে উপস্থিত হইল। তখন তাহারা গৃহহীন, আশ্রয়হীন, বৃক্ষতলবাসী; একমুষ্টি অন্নেরও সংস্থান নাই। কিন্তু ভগবান্ গৃহহীন নিরাশ্রয় অনাথকে ত্যাগ করেন না। তাঁহারই অপার যাতনায় বৃদ্ধ বৃদ্ধা সেই গ্রামের অধিবাসগিণের সহায়তা লাভ করিল, মহাপরাক্রান্ত সুবাদার যাহার শত্রু – তাহাকে অন্নবস্ত্র ও আশ্রয়-দানে তাহারা কুণ্ঠিত হইল না। গ্রামবাসিগণের আশ্রয়ে থাকিয়া তাহাদের সেবা-শুশ্রুষায় বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা কিছু দিনের মধ্যে সুস্থ হইল; এবং পদব্রজে দীর্ঘপথ অতিক্রম করিবার উপযুক্ত বল লাভ করিয়া, তাহারা একদিন প্রত্যুষে গ্রাম ত্যাগ করিল। পুনর্ব্বার তাহারা আগ্রা নগরে যাত্রা করিল।
বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা উভয়েই বোধ হয় অত্যন্ত সরল, অথবা অত্যন্ত নির্ব্বোধ। গ্রামবাসিগণের করুণায় তাহাদের করুণায় তাহাদের জীবন রক্ষা হইল। অথচ গ্রাম ছাড়িয়া তাহারা কোথায় যাইতেছে এ কথা তাহাদের অসময়ের বন্ধুগণের নিকট গোপন করিবে-ইহা অকৃতজ্ঞতার পরিচারক মনে করিয়া তাহারা তাঁহাদের গুপ্ত অভিসন্ধির কথা কাহারও কাহারও নিকট প্রকাশ করিয়াছিল। সে কথা কেহ বিশ্বাস করিয়াছিল কি না বলা যায় না, কিন্তু তাহারা গ্রাম হইতে প্রস্থান করিলে ক্রমে সে কথা সুবাদারের কর্ণগোচর হইল। তখন সুবাদার সাহেব তাহাদিগকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য চারিদিকে সোয়ার পাঠাইলেন; বর্দ্ধমান হইতে আগ্রা যাইবার পথে অশ্বারোহী সৈনিকেরা হাতিয়ারবদ্ধ হইয়া বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে বন্দী করিবার জন্য জুটিল। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছায় বাধা দেওয়া মনুষ্যের সাধ্যাতীত। কেহই বৃদ্ধ বৃদ্ধার সন্ধান পাইল না; তাহারা যেন ইন্দ্রজালপ্রভাবে কোথায় অদৃশ্য হইল। ব্যর্থমনোরথ হইয়া অশ্বারোহীরা রাজধানীতে ফিরিয়া আসিল। সুবাদার নবাব সৈয়ফ উল্লা নিষ্ফল আক্রোশে অধর-দংশন করিতে লাগিলেন। ক্রোধে জ্বলিতে লাগিলেন,-কিন্তু আসামী ফেরার, তিনি আর কি করিবেন? তখন তাঁহার মস্তিষ্কে যে ফন্দীর উদ্ভব হইল তদনুসারেই কাজ করিলেন। আগ্রার সম্রাট্-দরবারে তাঁহার বন্ধুবান্ধব, উজীর ওমরাহের অভাব ছিল না। তিনি বঙ্গের সুবাদার, তাঁহার অনুরোধ রক্ষা না করিবে কে? তিনি আগ্রাবাসী বন্ধুগণকে অনুরোধ করিলেন, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা যেন কোনও উপায়ে সম্রাট্সদনে উপস্থিত হইতে না পারে। সম্রাটের সহিত তাহাদের সাক্ষাতের সকল পথ যেন রুদ্ধ করা হয়।
বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা বহুকষ্টে দীর্ঘ পথ পদব্রজে অতিক্রমপূর্ব্বক পুনর্ব্বার আগ্রা নগরে উপস্থিত হইল। কিন্তু বঙ্গের সুবাদারের ষড়্যন্ত্রে সম্রাটের দরবারে প্রবেশের অনুমতি পাইল না; প্রহরীরা তাহাকে ঘণ্টার রজ্জু স্পর্শ করিতে দিল না। দুঃখ ক্ষোভ ও নিরাশায় তাহাদের হৃদয় পূর্ণ হইল।
কিন্তু বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার প্রতিজ্ঞা ও অটল; অত্যাচারের প্রতিকার না করিয়া তাহারা দেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিবে না, সঙ্কল্প করিল। তাহারা প্রত্যহ প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত প্রাসাদের সম্মুখস্থ পথপ্রান্তে সম্রাটের প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকিত।
কিন্তু সম্রাটের সহিত দীনদরিদ্রের সাক্ষাৎলাভের আশা সুদুরপরাহত; সম্রাট্ যে প্রাসাদ হইতে বহির্গত হইতেন না এমন নহে, কোনও দিন তিনি অনুচরবর্গে পরিবৃত হইয়া মৃগয়া করিতে যাইতেন; যদি পথিমধ্যে কোনও সুযোগে তাঁহার সহিত সাক্ষাত হয় এই আশায় বৃদ্ধ বৃদ্ধা দূর হইতে তাঁহার অনুসরণ করিত। সম্রাট্ কোনও দিন বা ওমরাহদিগকে সঙ্গে লইয়া লইয়া হস্তিপৃষ্ঠে আরোহণ পূর্ব্বক নগর দর্শনে বাহির হইতেন, বৃদ্ধ বৃদ্ধা সম্রাটের হস্তীর পশ্চাতে ধাবিত হইত; কিন্তু সম্রাটের সহিত সাক্ষাতের কোনও উপায় হইল না।
বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা তথাপি নিরাশ হইল না। প্রতিহিংসাই তাহাদের জীবনের ব্রত; সে ব্রত উদ্যাপনের জন্য তাহারা কোনও দিন অনাহারে থাকিয়া, কোনও দিন বা ভিক্ষালব্ধ অন্নে এক বেলা মাত্র আহার করিয়া সুযোগের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। এই ভাবে প্রায় ছয় মাস অতীত হইল।
প্রায় ছয় মাস পরে একদিন সম্রাট্ জল-ভ্রমণে বাহির হইলেন। সুসজ্জিত সুদৃশ্য তরণী-সমূহে আগ্রা নগরীর প্রান্তবাহিনী নির্ম্মলসলিলা যমুনা তন্বী নাগরীর ন্যায় শোভা ধারণ করিল। যথাসময়ে সম্রাট্ নদীকূলে উপস্থিত হইলেন; তাঁহার দেহরক্ষী সৈন্যদল নদীতীরে প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। সম্রাট্ জাহাঙ্গীর পারিষদবর্গের সহিত তাঁহার সুসজ্জিত তরণীতে আরোহণ করিতেছেন, এমন সময় নদীতীরস্থ লতাগুল্মের অন্তরাল হইতে হঠাৎ বাহির হইয়া বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা সম্রাটের ভাউলিয়ার সম্মুখে আসিয়া জানু নত করিয়া উপবেশন করিল, এবং কাতরস্বরে বলিল, ‘মুলুকের মালিক খোদাবন্দ, বিচার করুন; আমরা সুবিচার-প্রার্থনায় পুনর্ব্বার জাঁহাপনার চরণতলে উপস্থিত হইয়াছি।’
ভাউলিয়া হইতে সম্রাট্ তাহাদের কথা শুনিতে পাইলেন। তিনি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাহাদের মুখের দিকে চাহিলেন; তিনি তাহাদিগকে তৎক্ষণাৎ চিনিতে পারিলেন; তাঁহার পূর্ব্ব কথা স্মরণ হইল। মাঝিরা দাঁড় ফেলিয়া ভাউলিয়া মধ্য নদীতে লইয়া যাইবার উপক্রম করিতেছিল; তিনি তাহাদিগকে নৌ-পরিচালনে নিষেধ করিলেন, এবং বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে তাঁহার সন্নিকটে উপস্থিত হইতে আদেশ করিলেন।
বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা সম্রাটের পদতলে নিপতিত হইয়া তাহাদের অভিযোগ নিবেদন করিল; অশ্রুধারায় তাহারা ধরাতল সিক্ত করিল। সম্রাট্ তাহাদের উৎপীড়নকাহিনী শ্রবণ করিয়া অত্যন্ত বিচলিত হইয়া উঠিলেন। ক্রোধে ক্ষোভে তাহার হৃদয় পূর্ণ হইল; তিনি মধুর বাক্যে তাহাদিগকে আশ্বস্ত করিয়া বঙ্গের সুবাদারের নিকট এক পরোয়ানা প্রেরণ করিলেন; আদেশ হইল, সুবাদার অবিলম্বে আগ্রার উপস্থিত হইয়া তাঁহার দরবারে হাজির হইবেন। অনন্তর বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা যাহাতে সুখস্বচ্ছন্দে থাকিতে পায়, তাহার ব্যবস্থা করিবার জন্য কর্ম্মচারীদের প্রতি আদেশ প্রদত্ত হইল।
বঙ্গের সুবাদার নবাব সৈয়ফ উল্লা যথাসময়ে সম্রাটের আদেশলিপি প্রাপ্ত হইলেন। সম্রাট্ কি জন্য তাঁহাকে আগ্রা-নগরে আহ্বান করিয়াছেন সুবাদার তাহা বুঝিতে পারিলেন না; সম্রাট্ও তাঁহার অভিপ্রায় কাহারও নিকট প্রকাশ করেন নাই, সুতরাং সম্রাটের অভিসন্ধি নবাব সুবাদার সাহেবের জানিবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। সম্রাট্ কোনও বিষয়ের পরামর্শ করিবার জন্য তাঁহাকে আহ্বান করিয়াছেন মনে করিয়া, সুবাদার সৈয়ফ উল্লা মহা সমারোহে আগ্রানগরের সন্নিহিত হইলেন এবং যমুনা নদীর অপর পারে শিবির সংস্থাপনপূর্ব্বক সম্রাটের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া তাঁহার আগমন-সংবাদ জ্ঞাপন করিলেন।
সম্রাট্ জাহাঙ্গীর আদেশ করিলেন, পরদিন প্রত্যুষে একটি মত্ত হস্তীকে সুসজ্জিত করিয়া পথে বাহির করিতে হইবে। বৃদ্ধ-দম্পত্তিও সেই সময় রাজপথে উপস্থিত থাকিতে আদিষ্ট হইল।
সম্রাট্ প্রত্যুষে গাত্রোত্থান করিয়া রাজপথে বহির্গত হইলেন; এবং বৃদ্ধবৃদ্ধাকে সঙ্গে লইয়া যমুনাপারে উপনীত হইলেন। তাঁহার আদেশে সুসজ্জিত মত্ত হস্তীও যমুনার পরপারে নীত হইল। তখন সম্রাট্ বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে সেই হস্তীতে আরোহণ করাইয়া বঙ্গেশ্বরের শিবিরাভিমুখে তাহা পরিচালিত করিবার আদেশ দিলেন, এবং স্বয়ং সসৈন্য সেইদিকে অগ্রসর হইলেন।
সুবাদার সৈয়ফ উল্লার তখনও নিদ্রাভঙ্গ হয় নাই; যমুনাতীরস্থ সুদৃশ্য বস্ত্রাবাসের অভ্যন্তরে সুশীতল সমীরণ প্রবাহে তিনি সুখনিদ্রায় মগ্ন ছিলেন, এমন সময় সম্রাট্ সসৈন্য সুবাদারের বস্ত্রাবাসে উপস্থিত হইয়া নিদ্রিত সুবাদারের হস্তপদ দৃঢ়রূপে রজ্জু করিবার আদেশ প্রদান করিলেন।
ভারতেশ্বরের আদেশ তৎক্ষণাৎ প্রতিপালিত হইল। নবাব সৈয়ফ উল্লা নিদ্রাভঙ্গে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিলেন না, আর চেষ্টা করিলেও তাঁহার সে চেষ্টা সফল হইত না। তিনি ভীতিবিহ্বলনেত্রে সম্রাটের মুখের দিকে চাহিলেন; সম্রাট্ সেই মত্ত হস্তীর পৃষ্ঠে অবস্থিত বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার প্রতি তাঁহার দৃষ্টি আকৃষ্ট করিলেন। নবাব তৎক্ষণাৎ সকলই বুঝিতে পারিলেন, ভয়ে তাঁহার প্রাণ উড়িয়া গেল।
অনন্তর সম্রাটের আদেশে নবাবকে সেই অবস্থার প্রান্তরে নিক্ষেপ করা হইল। মত্ত হস্তীর মাহুত সম্রাটের ইঙ্গিতে সেই হস্তীকে নবাবের দেহের উপর দিয়া পরিচালিত করিল। হস্তীর পদতলে পিষ্ঠ হইয়া হতভাগ্য সুবাদার নবাব সৈয়ফ উল্লা প্রাণত্যাগ করিলেন। এইরূপ লোমহর্ষণ বর্ব্বর প্রথার ন্যায়ের সন্ধান রক্ষিত হইল!
নবাব সৈয়ফ উল্লা সম্রাট জাহাঙ্গীরের বাল্য-সহচর ছিলেন, তাঁহার প্রতি সম্রাটের স্নেহ ও অনুগ্রহের অভাব ছিল না; তথাপি তাঁহার অত্যাচারের এই কঠোর প্রতিফল প্রদত্ত হইল। বাল্য-সহচর ও বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী নবাব সৈয়ফ উল্লার মৃত্যুর পর সম্রাট্ ক্ষুব্ধ হৃদয়ে আগ্রা নগরীতে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন; এবং যথাযোগ্য সমারোহের সহিত মৃত নবাবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করিলেন। সুবাদারের মৃতদেহ অত্যন্ত জাঁকের সহিত সমাহিত হইল। দরবারীগণ দুইমাস কাল শোকচিহ্ণ ধারণের আদেশ পাইলেন।
অনন্তর সম্রাট্ দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া সভাসদ্গণকে বলিলেন, ‘আমি উহাকে স্নেহ করিতাম, কিন্তু রাজার হস্ত ন্যায়ের শৃঙ্খলে আবদ্ধ; রাজা ন্যায়বিচার করিতে বাধ্য তাহার অন্যথা করিবার উপায় নাই। সিংহাসনের ছায়া ক্ষুদ্র বৃহৎ সকলেই সমান; তাই হতভাগ্য সুবাদার স্বকৃত কর্ম্মের ফলভোগ করিল।’
‘ভারতবর্ষ’ ১ম বর্ষ ২য় খণ্ড ১ম সংখ্যা, পৌষ ১৩২০ বঙ্গাব্দ
Leave a Reply